Sunday, April 13, 2014

দুনিয়ার জীবন কত দিনের?

quote020313towards-death.jpg

১) আল্লাহ বলেনঃ 'পৃথিবীতে কয় বছর তোমার অবস্থান করেছিলে? তারা বলবেঃ আমরা একদিনের কিছু অংশ অবস্থান করেছি, অতএব তুমি গণনাকারীদের জিজ্ঞেস কর । তিনি বলবেনঃ তোমরা অল্প সময়ই অবস্থান করেছিলে, তোমরা যদি জানতে !
-( সূরা মু'মিনূন : ১১২-১১৪ )

২) যেদিন তারা তা দেখবে সেদিন তাদের মনে হবে, যেন তারা (পৃথিবীতে) এক সন্ধ্যা বা এক সকালের বেশী অবস্থান করেনি।
-( সূরা নাযিয়াত : ৪৬ )

৩) তারা কি যমীনে ভ্রমণ করেনা? তাহলে তারা হৃদয় দিয়ে বুঝতে পারত, আর তাদের কান শুনতে পারত । প্রকৃতপক্ষে চোখ অন্ধ নয়, বরং বুকের ভিতর যে হৃদয় আছে তাই অন্ধ ।
-( সূরা হাজ্জ : ৪৬ )
৪) এ বিষয় অন্যান্য সূরার আয়াতসমূহ দেখুনঃ হা-মীম আস সাজদা : ৫, কাহফ : ২৫, মা'আরিজ : ৪-৭।
  • উপরোক্ত আয়াত দিবালোকের ন্যায় প্রকাশিত হল এ জীবন কত দিনের, কত সময়ের এবং এর জন্য মানুষ কি না করছে। অনন্ত কালের আখিরাত বা পরকালের জীবনের তুলনায় দেখা গেল যে দুনিয়ার জীবনতো অল্প সময় মাত্র। কেননা গড়ে ৬০,৭০,৮০, বছর দুনিয়ার কর্মমুখর, কর্মক্লান্ত, ছুটন্ত বেচারার অবসরহীন জীবন কেটে গেল চরম পেরেশানীতে অথচ সেই পরকালের তুলনায় এত সময়ের হিসাব মাত্র এক সকাল বা এক সন্ধ্যা । একদিন বা দিনের একাংশ । আর এ জন্যই হানাহানি-মারামারি স্বার্থের দ্বন্দে দুনিয়ার জীবনটা কি বিষময় করে তুলেছি । এ কথা ভাবার সময় পান কত জনে? হাজারে একজনও কি মিলবে ? মহানাবী (সাঃ)-এর হুশিয়ারীঃ জান্নাতে যাবে হাজারে একজন, আর নয়শত নিরানব্বই জনই ওই অনন্ত কালের দাউ দাউ করা প্রজ্বলিত অনলে জ্বলবে । সে কি অসহায় জীবন! তা প্রত্যেক মুসলিম্লে অবশ্যই চিন্তা করতে হবে।

Wednesday, January 29, 2014

বুজুর্গ,পীর,দরবেশদের দাবী রাসূল (সাঃ) নূরের তৈরি এবং তার ছায়াও ছিলনা।

মহান আল্লাহ তা'আলা বলেন—

" তাদের অন্তর খেলায় মগ্ন। যালিমরা গোপনে পরামর্শ করেঃ তিনি তোমাদেরই মত মানুষ ছাড়া কি অন্য কিছু? তোমরা কি দেখে-শুনে যাদুর কবলে পরবে?"
—( সূরা আম্বিয়া : ৩ )

আরও বলেন—

" অথবা তোমার একটি স্বর্ণ নির্মিত গৃহ হবে, অথবা তুমি আকাশে আরোহণ করবে, কিন্তু তোমার আকাশে আরোহণ আমরা তখনও বিশ্বাস করবনা যতক্ষণ না তুমি আমাদের প্রতি এক কিতাব অবতীর্ণ করবে যা আমরা পাঠ করব। বলঃ পবিত্র আমার মহান রাব্ব! আমি তো শুধু একজন মানুষ, একজন রাসূল। "
—( বানী ইসরাইল : ৯৩ )

এ বিষয়ে অন্যান্য সূরায় আয়াতসমূহ দেখুনঃ হাজ্জ : ৭৫, রাদ : ৩৮, হা-মীম আসসাজদা : ৬, ফুরকান : ৭, ২০, মুমিনূন : ৩৩, ৩৪, ইবরাহীম : ১০-১১

=> মহান আল্লাহ তা'আলা আমাদের আদি পিতা আদম (আঃ) মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন অর্থাৎ মনব জাতি মাটির তৈরি। উপরে উল্লেখকৃত আল্লাহর আয়াতে অকাট্যভাবে প্রমাণ হল যে, রাসূল (সাঃ) একজন মানুষ ছিলেন। অতএব আমাদের রাসূল (সাঃ)-ও মায়ের গর্ভের মধ্যে সৃষ্টি। রাসূল (সাঃ) নূরের তৈরি কথাটি ঠিক নয়। তার ছায়া ছিলনা এ কথা সত্য নয়। কারণ, রাসূল (সাঃ) এর ছায়া না থাকলে অবশ্যই আরাববাসীরা বলতেন।
রাসুলাল্লাহ (সাঃ) ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত আরাববাসীদের নিকট "আল আমীন" (সত্যবাদী) ছিলেন। নাবুওয়াত প্রাপ্তির পর যখন তিনি প্রচার করলেন, "লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ" 'এক আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মা'বূদ নেই", সমস্ত মূর্তির ইবাদাত ছেড়ে একমাত্র আল্লা-হর ইবাদাত কর, তখনই আরাববাসীরা রাসূল (সাঃ) কে 'আল আমিনের' পরিবর্তে পাগল [নাউজুবিল্লা] আখ্যা দিতেও ছাড়েনি। আর যদি রাসূল (সাঃ)-এর ছায়া না থাকত তাহলে আরাববাসীরা রাসুলাল্লাহ (সাঃ) কে মানুষ না বলে অন্য কোনো নামে ডাকত।
নূরের তৈরি বস্তুর ছায়া থাকেনা এটা ঠিক। একটি বস্তুর ছায়া হয় কিভাবে? যখন আলো ওই বস্তু ভেদ করে চলে যেতে পারে না তখনি শুধু আলোর বিপরীতে ওই বস্তুর ছায়া পরে। আবার যখন আলো কোন বস্তুতে বাধা পেয়ে ফিরে এসে আমাদের চোখের পরদায় পরে তখন আমরা ওই বস্তুটাকে দেখতে পাই। অতএব বস্তুর ছায়া নেই সে বস্তু দেখা যায় না, যেমন বাতাসের ছায়া নেই। কারণ আলো বাতাসকে ভেদ করে চলে যায়, তাই বাতাসকে দেখা যায় না। তাহলে বুজুর্গ, দরবেশ বা পীরসাহেবরা ভবিষ্যতে এটাও বলবেন, " রাসুল (সাঃ)-কে কেউ দেখতে পেতেননা।" রাসুল (সাঃ)-কে সাহাবীগন (রাঃ) অবশ্যই দেখতে পেতেন। তাহলে রাসুল (সাঃ) এর দেহ ভেদ করে আলো যেত না, বরং আলো ফিরে এসে সাহাবাগণদের চোখে পরতো বলেই তারা দেখতেন। অতএব রাসুল (সাঃ) এর দেহ আমাদের মত রক্ত মাংসের ছিল। এ সমস্ত গাঁজাখুরি কথা বিশ্বাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রিধারীগন এ সমস্ত বুজুর্গ,দরবেশ বা পীরদের পূজা, পাইরুবী, সন্মান ও তোষামোদ করে চেলেছে আখিরাতে পার পাবার জন্য। সত্যি কি মহান আল্লা-হর রোষানল থেকে মনে এ বিশ্বাস পোষ্ণ করে পার পাওয়া যাবে?

Wednesday, November 13, 2013

শহীদগণ কি জীবিত থাকেন? তাদের জীবন কেমন? তারা কি দুনিয়ায় প্রত্যাবর্তন করতে পারে?

• আল্লাহর পথে জিহাদ করতে গিয়ে যারা কাফিরদের হাতে নিহত হয় তারা শহীদ । জিহাদ করার পর যারা জীবিত থাকে তাদেরকে গাযী বলা হয়। দুনিয়াবি দৃষ্টিকোণ থেকে শহীদরা মৃত। সেহেতু তাদের স্ত্রীগন বিধবা হয়। সন্তানরা ইয়াতিম হয়। তাদের সম্পদ বন্টন করা হয়। মানুষ শহীদকে দাফন করে। অতএব জানা গেল যে, দুনিয়াবি দৃষ্টিকো থেকে শহীদরা মৃত। কিন্তু আল্লাহর কাছে জীবিত থাকেন।

১। শহীদের সম্পর্কে আল্লাহ্‌ বলেনঃ

" বরং তারা (শহীদরা) তাদের রবের কাছে জীবিত এবং রিযিক প্রাপ্ত, তারা জীবিত কিন্তু তোমরা উপলব্ধি করতে পারনা।"
—( সূরা নিসা : ১৬৯ )

২। শহীদ দুনিয়ায় ফিরে আস্তে পারেনা। রসূলুল্ল-হ (সাঃ) বলেছেন—
একবার আল্লাহ্‌ শহীদগণ-কে জিজ্ঞেস করেন যে, তোমরা কি চাও? উত্তরে শহীদগণ বলেনঃ জান্নাতের মধ্যে যেখানে ইচ্ছা সেখানে বিচরণ, খাওয়া-পান করার আমাদের ইখতিয়ার রয়েছে। এর চেয়ে বেশি কি চাইবে হে আল্লাহ্‌! আল্লাহ্‌ ২য় ও ৩য় বার জিজ্ঞেস করলেনঃ (তোমরা কি চাও?) শহীদগণ যখন দেখলেন যে, না চেয়ে উপায় নেই, তখন আল্লাহর কাছে আবেদন করেনঃ হে আমাদের রব! আপনি আমাদের রূহ আমদের শরীরে ফিরিয়ে দিন যাতে আমরা দুনিয়ায় ফিরে গিয়ে আপনার রাস্তায় জিহাদ করে পুনরায় শহীদ হতে পারি। শহীদদের চাহিদা না থাকায় আল্লাহ আর প্রশ্ন করলেন না।
—( মুসলিম : ৪৭৩২)

৩। রাসুলাল্লাহ (সাঃ) বলেন—
শহীদ শাহাদাত বরণ করার সময় কোনো কষ্ট অনুভব করেনা এতটুকু ছাড়া, যেমন তোমাদের কেহকে পিপড়ায় কামড় দিলে তোমরা অনুভব কর।
—( ইব্ন মাজাহ : ২৮০২- আবূ হুরাইরা)

৪। ঋণ ছাড়া শহীদের সকল পাপই ক্ষমা করে দেয়া হয়।
—[ মুসলিম : ৪৭৩০-আ,ই,আস(রাঃ)]

Sunday, November 10, 2013

আশুরায়ে মুহাররাম করনীয় ও বর্জনীয়

✔প্রসংগ কথাঃ মুসলিম সমাজে আশুরায়ে মুহাররাম একটি সুপরিচিত বিষয়। বিশেষ করে শিয়া সম্প্রদায় এর কাছে বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন হলো আশুরায়ে মুহাররাম। তাই দেখা যায় অনেকেই এ দিনটিকে শুধুমাত্র শিয়াদের বিশেষ দিন মনে করে থাকেন, আবার কেউ শিয়াদের সংস্পর্শে থাকার কারণে তাদের ঐসব বিড়াল তাপশ কর্মসূচীতেও যোগ দিয়ে থাকেন। আসলে বিষয়টি কি শুধু শিয়াদের জন্যই নির্দিষ্ট না আশুরায়ে মুহাররামে সুন্নী মুসলমানদের জন্য কিছু রয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তরে বলব । হ‍্যাঁ অবশ্যই সুন্নী মুসলিমজাতির জন্যও কিছু করণীয় রয়েছে, তবে শিয়াদের দীন-ধর্মে যা প্রমাণিত তাই হলো সুন্নী মুসলমানদের করণীয় তাই হলো সুন্নী মুসলমানদের করণীয়, আসুন আমরা সংক্ষেপে আশুরায়ে মুহাররাম করণীয় ও বর্জনীয় বিষয় সমূহ জেনে নেই।

✔ পবিত্র মুহাররাম মাসঃ
বছরে মাসের সংখ্যা ও গণনা সম্পর্কে মহান আল্লাহ্‌ তা'আলা পবিত্র কুর'আনে বলেন—

" নিশ্চই আল্লা-হর বিধান ও গণনায় মাস বারটি, আর তা আসমান সমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তম্মধ্যে চারটি মাস হারাম বা সম্মানিত। এটি সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান, সূতরাং তোমরা এর মধ্যে নিজেদের উপর যুলুম অত্যাচার করনা।"
—( সূরা তাওবা : ৩৬ )

সাহাবী আবূ বাকরাহ (রাঃ) নবী (সাঃ) হতে বর্ণনা করেন তিনি (সাঃ) বলেন—
"বার মাসে এক বছর, তম্মধ্যে চারটি হারাম বা সম্মানিত মাস- যুলকাদাহ, যুলহিজ্জা ও মুহাররাম একত্রে তিন মাস এবং রজব মাস।"
—( সহীহ-উল বুখারী : ২৯৫৮ )

তাই মুহাররাম মাসটি হলো এমন এক সম্মানিত মর্যাদাশালী মাস যাতে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ।

✔ আশুরা কি?ঃ
আশুরা শব্দটির বিশ্লেষণ নিয়ে ভাষাবিদগন বিভিন্ন মতামত প্রকাশ করেছেন। অধিকাংশের নিকট মুহাররাম মাসের দশম তারিখেই হলো আশুরার দিন। ইহা আরবী শব্দ (عشر) আশারা হরে নির্গত, যার অর্থ হলো দশ। অতএব মুহাররাম মাসের দশম তারিখে রোযা রাখার নামই হলো আশুরার রোযা।
(দ্রঃ মির'আতুল মাফাতিহ ৭/৪৫ পৃষ্ঠা)

আশুরায়ে মুহাররাম-এর রোযা শুধু উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য নয় বরং ইহা পূর্ববর্তী যুগেও প্রচলিত ছিল।

আব্দুল্লাহ ইবনে ওমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন—
একদা রসূলুল্ল-হ (সাঃ) এর নিকট আশুরার দিবস সম্পর্কে আলোচনা করা হলে তিনি (সাঃ) বলেন— এদিনে জাহেলী যুগের লোকেরা রোযা রাখতো, অতএব যে (রোযা) রাখতে চায় রাখবে আর যে ছাড়তে চায় ছাড়বে।
—( সহীহ মুসলিম : ২৬৪২ )

সহীহ মুসলিম এর অন্য বর্ণনায় এসেছে আয়িশাহ্ (রাঃ) বলেন— জাহেলী যুগে মক্কায় কুরাইশ বংশের লোকেরা আশুরার রোযা রাখত এবং রসূলুল্ল-হ (সাঃ)-ও আশুরায় রোজা রাখতেন।
—( সহীহ মুসলিম : ২৬৩২ )

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত
তিনি বলেনঃ নবী (সাঃ) যখন মদীনায় আগমন করলেন তখন দেখলেন যে ইয়াহুদ সম্প্রদায় দশই মুহাররাম আশুরার রোযা রাখছে। তিনি প্রশ্ন করলেনঃ একি বিষয়? তারা বলল, এ হলো পবিত্র দিন, যে দিনে আল্লাহ্‌ তা'আলা বানী ইসরাইলকে তাদের শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন, ফলে মুসা (আঃ) সে দিনটি শুকরিয়া স্বরূপ রোযা রেখেছেন (আমারও তার অনুসরণ কররাখছি)। নবী (সাঃ) বললেনঃ আমি তোমাদের চেয়ে মূসা (আঃ) এর মত রোযা রাখার বেশী অধিকার রাখি, অতঃপর তিনি রোযা রাখেন এবং অন্যদের রোযা রাখার নির্দেশ দেন।
—( সহীহুল বুখারী : ২০০৪, সহীহ মুসলিম : ১১৩০ )

এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় বর্ধিত অংশ বলা হয়েছে যে, আশুরা এমন একটি দিন, যে দিনে নূহ (আঃ) এর কিশতী জুদী পর্বতে অবতরণ করে ফলে তিনি শুকরিয়া স্বরূপ ঐ দিনটি রোযা রাখেন। অতএব প্রমাণিত হয় যে, পূর্ববর্তী নবী ও উম্মাতের মাঝেও আশুরায়ে মুহাররাম এর রোযা রাখার ইবাদত চালু ছিল।

✔ আশুরায়ে মুহাররাম-এ করণীয়ঃ
আশুরায় মুহাররাম সম্পর্কে আমার পরিচিত হলাম।এখন জানা দরকার কুর'আন ও সহীহ হাদীসের আলোকে আমাদের করণীয় কি?
বিভিন্ন পেপার পত্রিকা ও মুসলিম বিশ্বের বাস্তব অবস্থার প্রতি নজর দিলে দেখা যায় মানুষ চার ভাগে বিভক্ত

√ ১. চরমপন্থি শিয়া সম্প্রদায়:
যাঁদের কাছে এ দিনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মূলতঃ তাদের ঐসব কর্মকান্ড মুহাম্মাদ (সাঃ) এর দীন-ধর্মে ভিক্তিহীন।

√ ২. যারা এদিন সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে গাফেল উদাসীন।

√ ৩. যারা এদিনকে কিছুটা গুরুত্ব দেয় তবে সীমাতিক্রম করে মিলাদ মাহফিল খাওয়া দাওয়া ইত্যাদি কর্মে লিপ্ত হয়ে থাকে।

√ ৪. যারা আল-কুর'আন ও সহীহ হাদীসের আলোকে এদিনটি যথাযথ মূল্যায়ন করে থাকেন। এরাই হল "হক"। ইহাই প্রতিটি উম্মাতের মুহাম্মাদীর উচিত। কুর'আন ও সহীহ হাদীসের আলোকে অন্য মাস বা দিনের এর ন্যায় দশই মুহাররামে একই ইবাদত, তবে বিশেষ ইবাদত হলো রোযা রাখা।

✔ আশুরায় রোযার ফযীলতঃ
আশুরার রোযার একটি বড় ফযীলতপূর্ণ রোযা, এর বদৌলতে শধু রোযারই ফযীলত পাওয়া যায় না বরং পূর্বের এক বছরের অপরাধ মোচন হয়ে যায়। নবী (সাঃ) বলেনঃ আমি আল্লাহ তা'আলার কাছে আশাবাদী যে, আশুরার রোযার বিনিময় তিনি পূর্বের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ্ মোচন করে দিবেন।
—( সহীহ মুসলিম : ১৯৭৬ )

✔ আশুরার রোযার হুকুম ও সংখ্যাঃ
পূর্বে আলোচিত হয়েছে যে, ইসলাম এর পূর্ব যূগ হতেই এ রোযার প্রচলন রয়েছে, অতঃপর নবী (সাঃ) এর মাধ্যমে তা ইসলামের ইবাদত হিসেবে গন্য হয়। রামাযান এর রোযা ফরয হওয়ার পর ইহা সকলের মতে সুন্নাত। কিন্তু রামাযানের রোযা ফরয হওয়ার পূর্বে তার হুকুম সম্পর্কে দিদ্বানগন ভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন, কেউ ওয়াজিব বলেছেন আবার কেউ সুন্নাত বলেছেন, তবে অনেকেই ওয়াজিব বলেছেন, কারণ নবী (সাঃ) নিজে রোযা রেখেছেন এবং সাহাবীদের রোযা রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আয়িশাহ্ (রাঃ) বলেনঃ রসূলুল্ল-হ (সাঃ) যখন মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করে গেলেন তখন তিনি নিজে রোযা রাখলেন এবং অন্যদের রোযা রাখার নির্দেশ দিলেন, অতঃপর যখন রামাযানের রোযা ফরয হলো তখন তিনি বললেনঃ যার ইচ্ছা হয় আশুরার রোযা রাখবে আর যার ইচ্ছা হয়, না রাখবে।
—(সহীহ মুসলিম : ২৬৩২)
নবী (সাঃ) সর্বপ্রথম আশুরার রোযা হিসেবে মুহাররাম মাসের দশ তারিখে শুধু একটি রোযা রাখেন এবং সে দিনটির ফযীলত বর্ণনা করেন। অতঃপর দশম হিজরীতে নবী (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করা হলো যে ইয়াহুদ সম্প্রদায় এ দিনটিকে খুব মর্যাদা দেয় এবং সে দিনটিতে রোযা রাখে তখন নবী (সাঃ) বলেনঃ যদি আমি আগামী বছর বেঁচে থাকি তাহলে নবম তারিখ সহ দু'টি রোযা রাখব। কিন্তু আগামী বছর আসার পূর্বেই তিনি দুনিয়া হতে বিদায় নেন।
—(সহীহ মুসলিম : ২৬৬১)

Thursday, November 7, 2013

রামাযান মাসে রাতের সলাত বা তারাবীহ সলাত সম্পর্কে

১| তারাবী অর্থ আরাম করা,বিশ্রাম করা,ধীরে ধীরে। বর্তমানে মুসলিম সমাজে রামাযানে ইশার সলাতের পর রাতের সলাতটি 'তারাবী' সলাত নামেই বিশেষভাবে পরিচিত। পবিত্র কুর'আন ও হাদীসের কোথাও এই তারাবীহ শব্দটির উল্লেখ নেই। হাদীসে এ সলাতকে صلو ة الليل (সালাতুল লাইল), رمضان قيام (কিয়ামে রামাযান),قيام الليل (কিয়ামুল লাইল) ও তাহাজ্জুদ নামে উল্লেখ করা হয়েছে।

আল্লাহর পবিত্র বানীঃ

২। তারা সবাই সমান নয়। আহলে কিতাবিদের এমন কতক লোকও আছে যারা দীনের উপর প্রতিষ্ঠিত আছে, তারা রাত্রিকালে আল্লা-হর আয়াতসমূহ পাঠ করে এবং তারা সেজদাহ করে থাকে।
—(সূরা আল-ইমরান : ১১৩)

৩। আর রাতের কিছু অংশে তার জন্য সাজদাহয় অবনত হও,আর রাতের দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর মহিমা বর্ণনা কর।
—(সূরা দাহর : ২৬)

৪। যে রাত্রির বিভিন্ন প্রহরে সাজদাহ ও দন্ডায়মান অবস্থায় বিনয় ও শ্রদ্ধা-ভক্তি প্রকাশ করে,আখিরাতকে ভয় করে,আর তার রবের অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে? বলঃ যারা জানে আর যারা জানেনা তারা কি সমান? বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে।
—(সূরা যূমার : ৯)

৫। তারা রাত্রিকালে খুব কমই শয়ন করত। আর তারা রাত্রি শেষ প্রহরে ক্ষমা প্রার্থনা করত।
—(সূরা যারিয়াত : ১৭-১৮)

হাদীসঃ

৬। আয়িশাহ্ (রাঃ) বলেনঃ
একদা রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম গভীর রাতে বের হয়ে মাসজিদে সলাত আদায় করেন, কিছুসংখ্যক পুরুষ তাঁর পিছনে সলাত আদায় করে। সকালে লোকেরা সম্পর্কে আলোচনা করে,ফলে লোকেরা অধিক সংখ্যায় সমবেত হয়। তিনি সলাত আদায় করেন এবং লোকেরা তাঁর সংগে সলাত আদায় করে।সকালে তারা এ বিষয় আলাপ-আলোচনা করে। তৃতীয় রাতে মাসজিদে মুসল্লীর সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। এরপর রসূলুল্ল-হ (সাঃ) মসজিদ থেকে বের হয়ে সলাত আদায় করেন ও লোকেরা তাঁর সংগে সলাত আদায় করে। চতুর্থ রাতে মাসজিদে মুসল্লীর সংকুলান হল না, কিন্তু তিনি রাতে আর বের না হয়ে ফাজরের সলাতে বেরিয়ে এলেন এবং সলাত শেষে লোকদের দিকে ফিরে প্রথমে তাশাহহুদ পাঠ করলেন। এরপর বললেনঃ
'আম্মা বাদ' শোন! তোমাদের (গতরাতের) অবস্থান আমার অজানা ছিলনা, কিন্তু আমি এই সলাত তোমাদের উপর ফারয্ হয়ে যাবার আশংকা করেছি (তাই বের হইনি)। কেননা তোমরা তাআদায় করায় অপারগ হয়ে পড়তে। রাসুলাল্লাহ (সাঃ) ৃমৃত্যু হয়ে যায়,আর ব্যাপারটি এভাবেই থেকে যায়।
—(বুখারী : ১৮৮০)

৭। আবূ হুরাইরা (রাঃ) আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলাল্লাহ (সাঃ) বলেন— যে ব্যক্তি রামাযান মাসের রাতে ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় সলাত আদায় করবে তার পূর্ববর্তী পাপসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।
—(বুখারী : ১৮৭৭)

৮। আবূ সালামা ইব্ন আব্দুর রহমান (রাঃ), আয়িশাহ্ (রাঃ)- কে জিজ্ঞেস করলেনঃ রামাযানে রাসুলাল্লাহ (সাঃ)-এর রাতের সলাত কিরূপ ছিল? তিনি বললেনঃ রসূলুল্ল-হ (সাঃ) রমাযান মাসে এবং রামাযান মাস ছাড়াও (অন্যান্য মাসে রাতের সলাত) এগার রাক'আত র অধিক সলাত করতেন না। চার রাক'আত সলাত আদায় করতেন, তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্বন্ধে তোমার প্রশ্নের অবকাশ নেই। তারপর চার রাক'আত সলাত আদায় করতেন, তারপর তিন রাকআত সলাত আদায় করতেন। তিনি বলেন, তখন আমি জিজ্ঞেস করলামঃ ইয়া রসূলুল্লাহ্ আপনার বিতর দায়ের আগে কি আপনি নিদ্রা যান? তিনি বললেনঃ হে আয়িশাহ্! উভয় চোখ তোহ ঘুমায়, কিন্তু আমার অন্তর ঘুমায়না।
—(বুখারী : ১০৭৬; মুসলিম : ১৫৯৩)

৯। আবূ সালাম (রাঃ) বলেন, আমি আয়িশাহ্ (রাঃ)-কে রসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর রাতের সলাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেনঃ তের রাক'আত সলাত আদায় করতেন। আট রাক'আত সলাত আদায় করতেন এবং যখন রুকূ ইচ্ছা করতেন তখন উঠে দাঁড়িয়ে রুকূ করতেন, তারপর আযান ও ইক্বামাতের মাঝে দু'রাক'আত সলাত আদায় করতেন।
—( মুসলিম : ১৫৯৪)

১০। আয়িশাহ্ (রাঃ) বলেনঃ রাতের বেলা রাসুলাল্লাহ (সাঃ)-এর সলাত ছিল দশ রাক'আত, এক রাক'আত দিয়ে বিতর আদায় করতেন। আর ফাজরের দু'রাক'আতও (সুন্নাত) আদায় করতেন। এই হল তের রাক'আত।
—(মুসলিম : ১৫৯৭)

১১। যায়িদ ইব্ন খালিদ আল-জুহানী (রাঃ) বলেন— (আমি স্থির করলাম) আজ রাতে আমি অবশ্যই রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ রাখব। তিনি প্রথমে সংক্ষেপে দু'রাক'আত সলাত আদায় করলেন। তারপর দু'রাক'আত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ দু'রাক'আত সলাত আদায় করলেন। তারপর দু'রাক'আত সলাত আদায় করলেন, যা তার পূর্ববর্তী রাক'আত এর চেয়ে কম দীর্ঘ। তারপর বিতর আদায় করলেন। এই হল মোট তের রাক'আত।
—(মুসলিম : ১৬৭৮)

১২। মাসরুক (রাঃ) বলেন, আমি আয়িশাহ্ (রাঃ)-কে রসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর রাতের সলাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন- ফাজরের দু'রাক'আত (সুন্নাত) ব্যতীত সাত বা নয় কিংবা এগার রাক'আত।
—(বুখারী : ১০৬৮)

১৩। আয়িশাহ্ (রাঃ) বলেন— নাবী মুহাম্মদ (সাঃ) রাতের বেলা তের রাক'আত সলাত আদায় করতেন, বিতর এবং ফাজরের দু'রাক'আত (সুন্নাত)-ও এর অন্তর্ভুক্ত।
—(বুখারী : ১০৬৯)

১৪। আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন— একদা রামাযান এর রাতে রসূলুল্ল-হ (সাঃ) স্বীয় গৃহ থেকে বের হয়ে দেখতে পান যে, মাসজিদের এক পাশে কিছু লোক সলাত আদায় করছে। তিনি (সাঃ) জিজ্ঞাস করেনঃ এরা কি করছে? তাঁকে বলা হয়ঃ এদের কুর'আন মুখস্থ না থাকায় তারা উবাই ইবন কা'বের (রাঃ) পিছনে (মুক্তাদী হিসেবে) সালাতুল লাইল (তারাবি) আদায় করছে । নাবী কারিম (সাঃ) বলেন, তারা ঠিক করছে।
—(আবূ দাউদ : ১৩৭৭)

১৫। সায়িব ইব্ন ইয়াযিদ (রাঃ) বলেছেনঃ উমার ইব্ন খাত্তাব (রাঃ),উবাই ইব্ন কা'ব এবং তামীমদারী (রাঃ)-কে লোকজন এর (মুসল্লীগণের) জন্য ১১ রাক'আত (তারাবীহ) কায়েম করতে (পড়াতে) নির্দেশ দিয়েছিলেন।
—[মুয়াত্তা ইমাম মালিক (র)/১ম খন্ড, ১৭১ পৃষ্ঠা]
#[ বিতর ৩ রাক'আত আদায় করলে তারাবী ৮ রাক'আত আর বিতর ১ রাক'আত আদায় করলে তারাবী ১১ রাক'আত আদায় করতে হবে।]

→ উপরোক্ত সহীহ হাদীসের বর্ণনাগুলির সার সংক্ষেপ হল, রামাযান মাস বা রামাযান ছাড়া অন্য মাসে রাসুলাল্লাহ (সাঃ)-এর রাতের নাফল সলাত ছিল ৮ বা ১০ রাক'আত, যা খলিফা উমার (রাঃ) নির্দেশও পাওয়া গেল ৮/১০ রাক'আত। ২০ রাক'আত তারাবী সালাতের বর্ণনা কোন সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়নি এবং খলিফা উমার (রাঃ) এর নির্দেশ এর কথাও বলা হয় নি। এই ২০ রাক'আত তারাবীহ সম্পর্কে কোন কোন মুহাদ্দিস যঈফ বা দুর্বল বলেছেন [মিশকাত শরীফ, তারাবী অধ্যায়, ৩য় খন্ড, লেখক- নূর মুহাম্মাদ আযমী]।
তা ছাড়াও গুত্বপূর্ণ তারাবী-র সলাত ২০ রাক'আত এর বর্ণনা সিহাহ সিত্তাহ অর্থাৎ বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ, ইব্ন মাজাহ,আবূ দাউদ এ সকল হাদীসে উল্লেখ নাই। খলিফা উমার (রাঃ) এর সুস্পষ্ট নির্দেশ এর হাদীসে ১১ রাক'আত বিতরসহ তারাবী সলাতের কথা পাওয়া যায় যা রাসূল (সাঃ) এর আমলের সাথেও মিল আছে। ১১ রাক'আত থেকে বিতর ১ রাক'আত আদায় করলে তারাবী হবে ১০ রাক'আত আর বিতর ৩ রাক'আত আদায় করলে তারাবী হবে ৮ রাক'আত। সে কারণে ৮ বা ১০ রাক'আত তারাবীহ সলাত আদায় করা উত্তম ও দলীল সম্মত। আর সবকিছু সর্বঅজ্ঞ আল্লাহই জানেন।

Monday, September 9, 2013

নিয়্যাত সম্পর্কে কয়েক মুসলমানদের ভুল ধারনা

নিয়্যাত আরবি শব্দ। এর অর্থ মনে মনে সংকল্প করা।
আল্লামা ইবনুল হুমাম হানাফী (র.) বলেন, হাদীসের কিছু হাফিয বলেছেন,রসূলুল্ল-হ (সাঃ) থেকে সহীহ এবং যঈফ কোন সানাদেও এ কথা প্রমাণিত নেই যে, তিনি সলাত শুরু করার সময় বলতেন যে, আমি এরূপ সলাত আদায় করছি। কোন সাহাবী এবং তাবিঈ থেকেও প্রমাণিত নেই। বরং এ কথা বর্ণিত আছে যে, তিনি (সাঃ) যখন সলাত শুরু করতেন তখন কেবল তাকবীর দিতেন। তাই মুখে নিয়্যাত পড়া বিদ'আত।
—( ফতহুল কাদীর ১ম খন্ড ১০৮ পৃষ্ঠা, কাবীরী ২৫২ পৃষ্ঠা)
আল্লামা শামী হানাফী (রহ.) বলেন, হিলয়্যাহতে এতটা বাড়তি আছে যে, চার ঈমাম থেকেও মখে নিয়্যাত পড়া প্রমাণিত নেই।
—( শামী ১ম খন্ড ৩৮৬ পৃষ্ঠা)
[সুত্রঃ আইনী তুহফা সলাতে মুস্তফা ১০৩ পৃষ্ঠ]

শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী (রহ.) তার "সিফাতু সালাতিন নাবী" গ্রন্থে এ মর্মে যা উল্লেখ করেছেনঃ "সলাত আদায়কারী যে সলাতের জন্য দাঁড়াবে মনে মনে তার সংকল্প করা ও ক্বিবলা নির্ধারণ করা আবশ্যক, যেমন যুহর কিংবা আসরের সলাত,অনুরূপে উক্ত দু'ওয়াক্তের সুন্নাত সলাতসমূহ, আর সেটা হচ্ছে শর্ত রুক্ণ।
সলাতে নিয়্যাত মুখে উচ্চারণ সুন্নাতের পরিপন্থী। অর্থাৎ বিদ'আত। চার ঈমামের কোন অন্ধ অনুসারীও মুখে কোন গদ বাধা শব্দ উচ্চারণ করতে বলেননি।
-( রসূলুল্ল-হ (সাঃ)- এর নামায- নাসিরুদ্দিন আলবানী ৫৩ পৃষ্ঠা )

Thursday, August 15, 2013

ইসলামে বক্রতার সৃষ্টি বা চার ইমাম এবং সুন্নাহ সম্বন্ধে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি

সময়ের সাথে সাথে মুসলিমদের মাঝে ফিক্‌হের চারটি ধারা জন্ম নেয় এবং বিস্তার লাভ করে ৷ আজ পর্যন্ত ঐ চারটি মাযহাবের প্রচুর প্রভাব পরিলতি হয় ৷ এই মাযহাবগুলি হচ্ছেঃ

১) হনাফী মাযহাব – এই মাযহাবের সূত্রপাত ঘটে কুফায়, যেখানে আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) এবংআলী ইবন আবু তালিব (রা.) এর মত সাহাবীরা বসবাস করতেন ৷ আবু হানিফা আল নু’মান ইবন সাবিতের (৮০ – ১৫০ হিজরী) নাম অনুসারে এই মাযহাব, হানাফী মাযহাব নামে পরিচিত ৷ ইসলামের ইতিহাসে তাঁকে সর্বকালের বৃহত্তম ফিক্‌হ শাস্ত্রবিদদের একজন বলে সবাই স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন ৷ আবু হানিফার সাথে তাঁর শিষ্য আবু ইউসুফ, মুহাম্মাদ আল হাসান এবং জাফর - এঁরা সবাই এই মাযহাবের গঠন ও বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখেন ৷ আধুনিক পাকিস্তান, ভারত, তুরস্ক, প্রাক্তন সাভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত মুসলিম রাষ্ট্রগুলো এবং পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে আজও হানাফী মাযহাব প্রাধান্য বিস্তার করে আছে ৷

২) মালিকী মাযহাব – এই মাযহাবের বিকাশ ঘটে নবীর (সা.) শহর মদীনায়, যেখানে তাঁর অনেক সাহাবী বসবাস করতেন ৷ এই মাযহাব মালিক বিন আনাসের (৯৫ – ১৭৯ হিজরী) নামানুসারে পরিচিত – যিনি হাদীসের একজন স্কলার ও ফিকাহশাস্ত্রবিদ ছিলেন ৷ এই মাযহাব দ্রুত উত্তর আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে যেখানে আজও এর প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়, উপরন্তু মুসলিম স্পেনেও এটাই ছিল প্রধান মাযহাব ৷

৩) শফিঈ মাযহাব- এই মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মুহাম্মাদ ইবন ইদ্রিস আল শাফি’ঈ (১৫০ – ২০৪ হিজরী) – যাঁর নাম অনুসারে এই মাযহাবের নামকরণ হয়েছে ৷ মক্কার একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করা আল শাফি’ঈ মদীনায় গমন করেন ৷ তিনি ইরাকেও যান এবং আবু হানিফার ছাত্র মুহাম্মাদ আল হাসানেরসাথেও কথাবার্তা বলেন ৷ উসূল আল ফিক্‌হ বা ইসলামী আইনতত্ত্বের উপরে প্রথম পুস্তকের সংকলন ইমাম শাফি‘ঈই করেছিলেন ৷ এটা একটা বিশাল কাজ ছিল এবং এতে ইসলামে সুন্নাহর কর্তৃত্ব ও মর্যাদা স্পষ্ট করে নির্দেশিত হয়েছে ৷ আজকের দিনে মিশর, সিরিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং অন্যান্য স্থানে শাফিঈ মাযহাবের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয় ৷

৪) হাম্বলী মাযহাব – আহমাদ বিন হাম্বলের (১৬৪ – ২৪১ হিজরী) নামানুসারে এই মাযহাব পরিচিত ৷ ইমাম আহমাদ ছিলেন হাদীসের এক বিশাল পন্ডিত ব্যক্তি ৷ মুসনাদ আহ্‌মাদ নামে এক বিশাল গ্রন্থের তিনি ছিলেন প্রণেতা ৷ ফিকাহের ব্যাপারে তিনি তাঁর শিক্ষক ইমাম আল-শাফি’ঈ কর্তৃক গভীরভাবে প্রভাবিত হন ৷ আজকের দিনের সৌদী আরবে, হাম্বলী মাযহাবই হচ্ছে প্রধান ৷

সুন্নাহ ও হাদীসের গুরুত্ব সম্পর্কে স্কলারদের ধ্যান-ধারণা বোঝাটা গুরুত্বপূর্ণ ৷ কেননা কোন হাদীস যখন তাদের মাযহাবের মতের বিরুদ্ধে যায়, তখন তাদের অনুসারীরা সেই সব হাদীস অনুসরণ করার ব্যাপারে তীব্র বিরোধিতা করে থাকেন ৷ তারা ধরেই নেন যে, তাদের স্কলাররা নিশ্চয়ই হাদীসটি জানতেন এবং জেনে শুনে সঙ্গত কারণেই তারা হাদীসটির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন ৷

সুন্নাহ এবং হাদীস সম্বন্ধে চার ইমামের বক্তব্যের ভিতর থেকে আমরা নিম্নলিখিত বক্তব্যগুলো তুলে দিলাম:

ইবন আল মুবারকের বর্ণনায় এসেছে যে, ইমাম আবু হানিফা বলেন, “যদি আল্লাহর রাসূলের (সা.) কাছ থেকে কোন বর্ণনা আসে, তবে সেটাই হচ্ছে মস্তিষ্ক ও চক্ষু (অর্থাৎ সেই ব্যাপারের সবকিছু – সেখানে আর বিতর্ক করার কোন অবকাশ নেই)৷ যদি নবীর (সা.) সাহাবীদের কাছ থেকে বর্ণনা আসে, তবে তাদের বক্তব্যগুলোর মধ্য থেকে আমরা (কোন একটি) বেছে নিই ৷”
আবু হানিফা বলেন, “আল্লাহ্‌র দ্বীন সম্পর্কে নিজের মতামতের ভিত্তিতে কথা বলার ব্যাপারে সাবধান থেকো ৷ তোমাদের অবশ্যই সুন্নাহর সাথে লেগে থাকা উচিত ৷ যে এর থেকে দূরে থাকে সেই পথভ্রষ্ট হল (সে সিরাতুল মুস্তাক্বীম থেকে সরে গেল) ৷”
তিনি আরো বলেন, “সুন্নাহ যদি না হতো, তাহলে আমরা কেউই কুর’আন বুঝতে সক্ষম হতাম না ৷” আরেকটি উপলক্ষে তিনি বলেন, “মানুষ ততদিন পর্যন্ত ভালোর মধ্যে থাকবে, যতদিন তারা হাদীস শিক্ষা ও অনুসন্ধান করতে থাকবে ৷ তারা যদি হাদীস ছাড়া জ্ঞানের অনুসন্ধান করে, তবে তারা পচে যাবে – কারোরই কোন কথা বলা উচিত নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত সে জানবে না যে, রাসূলের (সা.) আইন ঐ কথাটির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ৷”
ইমাম আবু হানিফাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, “আপনি যদি এমন কোন বক্তব্য দেন, যা আল্লাহর কিতাবের সাথে বিরোধপূর্ণ হয় (তাহলে কি করা হবে) ?” তিনি উত্তর দেন, “আল্লাহর কিতাবের পক্ষ অবলম্বন করে আমার বক্তব্য ত্যাগ করবে ৷” তারপর বলা হলো, “যদি ধরুন তা রাসূল (সা.)-এঁর কোন বর্ণনার বিরোধিতা করে?” তিনি বলেন, “রাসূলের (সা.) বর্ণনার পক্ষাবলম্বণ করে আমার বর্ণনা ত্যাগ করবে ৷” আবু হানিফার ছাত্র মুহাম্মাদ ইবন আল হাসানের সূত্রেও উপরের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে ৷ আরো বর্ণিত রয়েছে যে, তিনি বলেন, “হাদীস যদি সহীহ হয় তবে সেটাই আমার মত (মাযহাব) ৷”
উসমান ইবন ওমর-এর বর্ণনায় এসেছে যে, এক ব্যক্তি একবার ইমাম মালিকের কাছে এলো এবং তাঁকে একটি প্রশ্ন করলো ৷ ইমাম মালিক জবাবে বললেন, “আল্লাহর রাসূল (সা.) এমন এমন বলেছিলেন ৷”লোকটি জিজ্ঞেস করলো, “আপনার মত কি?” মালিক তখন কেবল কুর’আনের একটি আয়াত যেখানে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে সেটি দিয়ে তার জবাব দিলেন-

“সুতরাং যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা সতর্ক হয়ে যাক যে তাদের উপর বিপর্যয় নেমে আসবে অথবা মর্মন্তুদ শাস্তি নেমে আসবে ৷” (সূরা নূর, ২৪:৬৩)

ইমাম মালিক থেকে আরো উদ্ধৃত করা হয় যে তিনি বলেন, “আমি কেবলই একজন মানুষ ৷ আমি ভুল করি এবং আমি অন্যসময় সঠিকও হই ৷ আমার মতামত পরীক্ষা করে দেখ ৷ আমার মতের যা কিছু আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাহর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, তা গ্রহণ কর, আর যা কিছু আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাহর সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ তা বর্জন কর ৷”
আল রাবীর বর্ণনায় এসেছে যে, ইমাম আস-শাফি‘ঈ বলেন, “আমার বইয়ে যদি তোমরা এমন কিছু পাও, যেটা আল্লাহর রাসূলের (সা.) চেয়ে ভিন্ন হয়, তবে সুন্নাহ অনুযায়ী কথা বলো এবং আমি যা বলেছি সেটা বর্জন কর ৷” আস-শাফিঈ আরো বলেন, “যদি হাদীসটি সহীহ হয় তবে সেটাই আমার মত ৷ ”
আল-হুমাইদি বলেন যে, আস-শাফি‘ঈ একদিন একটি হাদীস বর্ণনা করলেন এবং আল হুমাইদি তখন তাঁকে বললেন, “আপনি কি এটা অনুসরণ করেন?” তিনি উত্তর দিলেন, “তুমি কি আমাকে গির্জা থেকে বেরিয়ে আসতে দেখ না কি জিনার (বিশেষভাবে নন-মুসলিমদের দ্বারা পরিহিত এক ধরণের কোমরবন্ধ) পরিহিত অবস্থায় দেখ? আমি রাসূল (সা.)-এঁর একটা হাদীস শুনব আর অনুসরণ করবো না?”
তিনি বোঝাতে চাইছিলেন যে, কেবল একজন অমুসলিম – যেমন একজন খৃষ্টান যে কিনা গির্জায় যায় – কেবল সেই ওরকম আচরণ করতে পারে ৷
আহমাদকে (রহ.) একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আওজায়ীর মতামত অনুসরণ করা ভাল না মালিকের মতামত অনুসরণ করা ভাল? এবং তিনি বলেন,

 “তোমাদের দ্বীনে তোমরা তাদের কাউকেই অন্ধভাবে অনুসরণ করো না ৷ যা কিছু নবী (সা.) ও তাঁর সাহাবীদের কাছ থেকে এসেছে তাই গ্রহণ কর …..৷”

ইমাম আহমাদের পদ্ধতি বর্ণনা করতে গিয়ে দীর্ঘ অধ্যায়ের শুরুতে ইবনুল কাইয়্যেম বলেন, “কোন ব্যাপারে ইমাম আহমাদ যদি একটা দলীল (কুর’আনের আয়াত বা একটি হাদীস) পেতেন, তাহলে তিনি সেই অনুযায়ী ফতোয়া দিতেন এবং এমন কিছু বা কারো ব্যাপারে ভ্রক্ষেপ করতেন না যে সেটার বিরোধিতা করতো – সে যেই হোক না কেন ৷ সেজন্যেই জনৈক মহিলার চূড়ান্ত তালাকের ব্যাপারে তিনি ওমরের (রা.) মতামত বিবেচনা করেননি, বরং তিনি ফাতিমা বিনতে কায়েসের (রা.) হাদীস অনুসরণ করেন …..৷”
এইসব মাযহাবগুলোর সবচেয়ে বিশ্বস্ত অনুসারীরা যুক্তি দেখান যে, তারা যেসব স্কলরদের অনুসরণ করেন তারা কখনোই ইচ্ছে করে রাসূল (সা.)-এঁর কোন হাদীসের বিপক্ষে কোন অবস্থান নেবেন না – যেমনটা আমরা আগেই বলেছি ৷ এ ব্যাপারে একটা ঐক্যমতে পৌঁছানো প্রয়োজন ৷ কারো এই অভিযোগ উত্থাপন করা উচিত নয় যে, এইসব সৎ ও পরহেজগার স্কলারদের কেউ ওরকম একটা কাজ করতে পারেন ৷ এটা একটা স্বীকৃত ব্যাপার যে, কোন কারণ ছাড়া তারা একটা সহীহ হাদীসের বিপক্ষে কখনো কিছু করেন নি ৷ এই যুক্তিতে তাদের অনুসারীরা বলবেন যে, তাদের কোন মতামত যদি একটি হাদীসের বিপক্ষে যায়, তবে সেই হাদীস অবজ্ঞা করার ব্যাপারে তাদের কাছে নিশ্চয়ই অধিকতর গ্রহণযোগ্য কোন যুক্তি ছিল ৷ উদাহরণস্বরূপ, এমন কথা বলা হয় যে, ঐ নির্দিষ্ট হাদীসটি হয়তো মানসুখ বা বাতিল হয়ে গেছে -অথবা- সেটা হয়তো আসলে সহীহ নয়, বা তা হয়তো সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ব্যাপারে প্রযোজ্য নয় ৷
এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে, এরকম একটা যুক্তির পিছনে হয়তো কিছু গ্রহণযোগ্য কারণও থেকে থাকবে ৷ কিন্তু আরো সুচিন্তিত যুক্তিতর্ক এটা প্রতীয়মান করতে পারে যে, এ ব্যাপারে নিরাপদ এবং অধিকতর যুক্তিযুক্ত পদ্ধতি একদমই ভিন্ন ৷
এটা বোঝা উচিত যে, একটা নির্দিষ্ট হাদীস অনুসরণ না করার পিছনে তাদের স্কলারদের পক্ষ হয়ে তারা যে যুক্তি দেখান – সেগুলোই যে কোন নির্দিষ্ট স্কলারের কোন নির্দিষ্ট হাদীস অনুসরণ না করার একমাত্র কারণ, তেমন নয় ৷ আসলে, সেই কারণগুলো হয়তো মোটেই প্রধান কারণ নয় ৷ উদাহরণস্বরূপ: এটা সম্ভাব্য যে, একজন স্কলার হয়তো ঐ নির্দিষ্ট হাদীসটি সম্বন্ধে জ্ঞাতই ছিলেন না ৷ এরকম হওয়াটা অসম্ভব কিছু নয় অথবা এর অর্থ এটাও নয় যে, এমন হলে তা কোন নির্দিষ্ট স্কলারের সামর্থের উপরে কোন কালিমা লেপন করে - এমন কোন সাহাবীই ছিলেন না যিনি রাসূল (সা.)-এঁর সব হাদীসগুলো সম্বন্ধে জ্ঞাত ছিলেন ৷ উপরন্তু এমনও হতে পারে যে, কোন মাযহাবের অনুসারীদের অনুসৃত স্কলার মুহাদ্দিসদের মতো হাদীস শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ ছিলেন না, আর তাই হয়তো ঐ হাদীসটিকে তিনি দুর্বল ভেবেছেন – সম্ভবত যে উপায়ে তা তার কাছে এসে পৌঁছেছিল সে জন্য ৷ অথচ হাদীস বিশেষজ্ঞরা (পরবর্তীতে হয়তো) ঐ নির্দিষ্ট হাদীসটিকে সহীহ বলে চি‎হ্নিত করেছেন ৷ হাদীস অনুসরণ না করে যে ব্যক্তিটি তার মাযহাব অনুসরণ করার পক্ষে যুক্তি দেখান, সেই যুক্তির চেয়ে আমরা মাত্র যে যুক্তি উপস্থাপন করলাম, তা মোটেই কম গ্রহণযোগ্য নয় ৷ মনে করুন একজন ব্যক্তির কাছে একটা হাদীস উপস্থাপন করা হলো এবং তাকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে বলা হলো যে, হাদীসের স্কলাররা ঐ হাদীসটিকে সহীহ বলে নির্ধারণ করেছেন ৷ বাস্তবে এটা হচ্ছে একটা হাদীস যা অন্যান্য মাযহাবগুলো গ্রহণ করে এবং প্রয়োগ করে ৷ এবং ধরে নেয়া যাক যে, ঐ ব্যক্তিটি যে মাযহাবের অনুসরণ করে, হাদীসটি তার বিরোধিতা করে এবং ঐ ব্যক্তিটির কোন ধারণাই নেই যে, তার মাযহাব কেন ঐ নির্দিষ্ট হাদীসটি প্রয়োগ করছে না ৷ এখন ঐ ব্যক্তিটির সামনে দু’টো পথ খোলা রয়েছে:
ক) যতক্ষণ পর্যন্ত ঐ হাদীসটি অনুসরণ না করার সে কোন কারণ পাচ্ছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত সে তা অনুসরণ করতে থাকবে ৷
খ) সে ধরে নেবে যে, ঐ হাদীস মেনে না চলার পিছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে আর সেজন্য সে ঐ হাদীসের বিপক্ষে তার মাযহাবের মত অনুসরণ করবে ৷
সে যদি উপরের বর্ণিত ‘ক’ অনুসারে চলে, তবে স্বভাবতই দুইয়ের মধ্যে অপেক্ষাকৃত ভাল পথটি বেছে নেবে ৷ এটা যে অপেক্ষাকৃত ভাল পথ তা বলার জন্য বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে ৷ প্রথমত, কিয়ামতের দিন সে আল্লাহর সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলতে পারবে যে, যা কিছু রাসূল (সা.)-এঁর বক্তব্য হিসাবে তার সামনে উপস্থিত করা হয়েছিল, সে তাই অনুসরণ করেছে ৷ রাসূল (সা.)-এঁর প্রতি আনুগত্যকে ফরজ করে এবং তাঁর আনুগত্যের আদেশ দিয়ে কুর’আনে সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ রয়েছে; যদিও আমরা জানি যে, পক্ষান্তরে আবু হানিফা, মালিক, আহমাদ, আস-শাফিঈ বা অন্য কোন ব্যক্তিকে অনুসরণ করার ব্যাপারে কোন আদেশ নেই ৷ সুতরাং এমন যদি দেখা যায় যে, কোন একটা নির্দিষ্ট হাদীস আসলে, উদাহরণস্বরূপ, বাতিল হয়ে গিয়েছিল, তবুও তা অনুসরণ করার ব্যাপারে তার অবস্থান যুক্তিযুক্ত থাকবে এবং ইনশা’আল্লাহ কিয়ামাতের দিন সে নিরাপদ অবস্থানে থাকবে ৷ দ্বিতীয়ত, সেক্ষেত্রে সে তার নিজের ইমামের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করে থাকবে ৷ যেমনটা আমরা দেখেছি যে, চারজন ইমামই যখন তাঁদের কোন শিক্ষা নবী (সা.) যা বলেছেন, তার সাথে বিরোধপূর্ণ হবে তখন সেই শিক্ষা প্রত্যাখ্যান করা বা বর্জন করার কথা বলে গেছেন ৷ সুতরাং সেক্ষেত্রে সে যে স্কলারের উপর আস্থাশীল, অর্থাৎ তার ইমাম, তাকে তার ভ্রান্তির জন্য ক্ষমা করে দিয়ে এবং রাসূল (সা.)-এঁর সুন্নাহ অনুসরণ করে সে আসলে ঐ ইমামরে পরামর্শই মেনে চললো ৷ কিন্তু যদি ঐ ব্যক্তি ‘খ’ তে বর্ণিত পথ অনুসরণ করে, তবে সে আসলে এক ধরণের অনুমানবশত কাজ করা ছাড়া আর কিছুই করলো না ৷ বাস্তবে সে একটা ত্রিমুখী অনুমানের বশবর্তী হয়ে কাজ করলো ৷ প্রথমত, সে অনুমান করছে যে, তার ইমাম বা স্কলার আমাদের আলোচ্য নির্দিষ্ট হাদীসটি সম্বন্ধে জানতেন ৷ দ্বিতীয়ত, সে ধরে নিচ্ছে যে, তার ইমাম বা স্কলার হাদীসটি কোন শ্রেণীর তা জানতেন অথবা হাদীসটি তার ইমামের কাছে গ্রহণযোগ্য সূত্রের মাধ্যমে পৌঁছেছে ৷ তৃতীয়ত, সে এটা অনুমান করছে যে, তার ইমামের ঐ হাদীস মেনে না চলার জন্য পর্যাপ্ত ও শক্তিশালী যুক্তি বা কারণ ছিল ৷
সম্ভাব্যতার সূত্র বলে যে, কোন একটা ঘটনার জন্য যত বেশী বিষয় অনুমান করা হয়, ঘটনাটার সম্ভাব্যতা তত কমে যায় ৷ আবার সে যখন জানেনা যে তার মাযহাব কেন ঐ নির্দিষ্ট হাদীসটি অনুসরণ করে না, তখন তাকে অবশ্যই ধরে নিতে হবে যে তা অনুসরণ না করার জন্য তাদের খুব ভাল যুক্তি রয়েছে ৷ এটা সত্যি যে, তার স্কলারদের পারদর্শিতার উপর তার আস্থা থেকেই এমনটা মনে হয়ে থাকবে, কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যাপারটা তার পক্ষ থেকে স্রেফ একটা অনুমানের চেয়ে বেশী কিছু বলে মনে করার উপায় নেই – একটা অনুমান যার সত্য হওয়ার সম্ভাব্যতা খুবই ক্ষীণ ৷ কোন ব্যক্তির দ্বীন এবং আমল কেবলমাত্র অনুমানের উপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয় ৷ এটা এমন একটা ব্যাপার যে সম্বন্ধে কুর’আনের বহু আয়াতে আল্লাহ সতর্ক করে দিয়েছেন ৷ উদাহরণস্বরূপ আল্লাহ মূর্তিপূজকদের অনুমানের উপর ভিত্তি করে তাদের ধর্মকর্ম পালনের ব্যাপারে দোষারোপ করেন এবং বলেন:
“তাদের অধিকাংশ অনুমানেরই অনুসরণ করে, সত্যের পরিবর্তে অনুমান কোন কাজে আসে না, তারা যা করে নিশ্চয়ই আল্লাহ সেই বিষয়ে সবিশেষ অবহিত ৷” (সূরা ইউনূস, ১০:৩৬)
আল্লাহ আরো বলেন:
“অথচ এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই, তারা তো কেবল অনুমানেরই অনুসরণ করে ৷ কিন্তু সত্যের মুকাবিলায় অনুমানের কোনই মূল্য নেই ৷” (সূরা আন-নাজম, ৫৩:২৮)
কোন ব্যক্তি যদি এভাবেই নিজের অনুমানের অনুসরণ করেন, তবে তিনি যখন কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে দাঁড়াবেন, তখন তার নিজের পক্ষে কোন অজুহাত বা যুক্তি থাকবে না ৷ তার সামনে নবীর (সা.) কথা উপস্থাপন করা হয়েছিল, ওগুলো যে নবীর (সা.) কথা তা সন্দেহ করারও তার কোন কারণ ছিল না, তবু তিনি এজন্য সেগুলো অনুসরণ করেননি যে, তিনি অনুমানবশত ধরে নিয়েছিলেন যে, ঐ কথাগুলো অনুসরণ না করার জন্য তার ইমামের কাছে নিশ্চয়ই কোন কারণ ছিল ৷
সুতরাং, এ ব্যাপারে সঠিক মনোভাব হচ্ছে এই যে, যখন কারো সামনে নবী (সা.)-এঁর একটা সহীহ হাদীস উপস্থাপন করা হয়, তার অবশ্যই সর্বান্তকরণে সেটাকে অনুসরণ করা উচিত, এবং তার সাধ্য অনুযায়ী সর্বতোভাবে তা প্রয়োগ করার আকাঙ্খা হওয়া উচিত৷ যখন সে তা করবে, তখন এই জীবনে সে সবচেয়ে সঠিক রাস্তাটিই এবং আখিরাতের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ রাস্তাটিই অনুসরণ করবে ৷ আল্লাহর রাসূলের (সা.) একটা সহীহ হাদীসকে কেউ কেবল এবং কেবল তখনই পরিত্যাগ করবে, যদি, এর বিপরীতে তার সামনে সমপর্যায়ের শক্তিশালী প্রমাণ উপস্থাপন করা হয় ৷